রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯)–কে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক নিন্দা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, বিএনপির ঢাকা-৭ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ইসহাক সরকারের নেতৃত্বাধীন একটি চক্রের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন সোহাগ।
সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই এলাকায় চাঁদা তোলার দায়িত্ব নেন ইসহাক সরকার। তিনি প্রতি মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। দীর্ঘদিন ধরে সোহাগ তার হয়ে এই টাকা সংগ্রহ করতেন। সম্প্রতি চাঁদার অঙ্ক দ্বিগুণ করে ১২ লাখ টাকায় উন্নীত করলে ইসহাক সরকার নতুন দায়িত্ব দেন যুবদল নেতা মাহমুদুল হাসান মহিনকে।
এ সিদ্ধান্ত জানার পর সোহাগ ইসহাক সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকতে লালবাগ এলাকার বিএনপি নেতা হামিদুর রহমান হামিদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ইসহাক গ্রুপ, এবং পরিকল্পনা করে সোহাগকে হত্যা করার। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হয় মহিনকে।
বুধবার সন্ধ্যায় মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের সড়কে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও মাথায় পাথর মেরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সোহাগকে। হত্যাকাণ্ডের সময় শত শত মানুষ উপস্থিত থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেননি।
এই ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব এ পর্যন্ত মোট চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিন। র্যাবও গ্রেপ্তার করেছে আরও দুইজনকে, তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। পুলিশ রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করেছে।
শুক্রবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল রানা আদালতে হাজির করলে মাহমুদুল হাসান মহিনের পাঁচদিন ও রবিনের দুইদিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বৃহস্পতিবার কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, ভাঙারি ব্যবসা ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আসামিদের সঙ্গে সোহাগের বিরোধ চলছিল। সেই বিরোধের জেরে তারা তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তালাবদ্ধ করে দেয় এবং এলাকা ছাড়ার জন্য নানা হুমকি দেয়।
এজাহারে উল্লেখিত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন: মাহমুদুল হাসান মহিন, সরোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাকিব, সাবাহ করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, মো. সিরাজুল ইসলাম, রবিন, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী ও আনিসুর রহমান হাওলাদার। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ১৫-২০ জনকেও আসামি করা হয়েছে।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অন্তত ছয়জনের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদের মধ্যে সরোয়ার হোসেন টিটু চকবাজার থানা যুবদলের সাবেক সদস্য এবং অপু দাস ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। অন্যদিকে মনির হোসেন মিটফোর্ড হাসপাতালে আউটসোর্সিং কর্মী এবং নান্নু একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে কাজ করেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকার পরিবর্তনের পর ওই এলাকায় চাঁদাবাজি, ফুটপাত দখল, হাসপাতালের নিয়োগ-বাণিজ্য ও ওষুধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একটি সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করছিল। তাদের সঙ্গে মিটফোর্ড হাসপাতালের এক পরিচালকের ও বিএনপি নেতা মরহুম নাসির উদ্দিন পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনার সম্পর্ক রয়েছে বলেও দাবি করা হচ্ছে। কিছু ছবিও এর প্রমাণ হিসেবে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, সোহাগকে হত্যার পরও খুনিরা তার নিথর দেহের ওপর পাথর নিক্ষেপ ও পায়ে দাঁড়িয়ে উল্লাস করতে থাকে। শরীর থেকে তার পোশাক খুলে নেওয়া হয়। এ সময় আশপাশে অসংখ্য মানুষ থাকলেও কেউ ভয়ভীতির কারণে এগিয়ে আসেনি।
ঘটনার জেরে তাৎক্ষণিকভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় বিএনপি। যুবদল নেতা রজব আলী পিন্টু ও সাবাহ করিম লাকিকে দল থেকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, দল কোনো অপরাধীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না এবং ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে পরিচালিত হয়।
যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়নের স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে জানানো হয়, এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সকলকে বিচারের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা করবে দল। সেই সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের অভিযুক্তদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, প্রকাশ্যে পাথর মেরে মানুষ হত্যা ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরতা। এটি আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণসংহতি আন্দোলন পৃথক বিবৃতিতে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা, জগন্নাথ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে চরম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন অনেকে।